সোমবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৫

কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে


কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে
ছবিটি এআই দিয়ে বানানো

শিরোনামে করা প্রশ্নটি গত কয়েক দিনে অনেকেই আমাকে করেছেন। উত্তর তো দিতেই পারিনি, উল্টো সম্পূরক আরও অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিয়েছে আমার নিজের মনেই।

সংবাদমাধ্যম আর ফেসবুকে চোখ রেখে অনেকেরই নাকি মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনও জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পরিচালকের ২৫টি চেয়ারের প্রতিটিই এখানে বেশ লাভজনক। নইলে এই এক নির্বাচন নিয়ে এত দলাদলি, এত সমঝোতার নাটক, মামলা-মোকদ্দমা এবং এত চক্ষু লজ্জা বিসর্জন দেওয়া কেন? নিশ্চয়ই বিসিবির সিন্দুকে অমূল্য ধন–রত্ন আছে। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারছে না—কী সেই ধন রত্ন। কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে!

বলে রাখা ভালো, বিসিবির পরিচালকদের কোনো মাসিক বেতন বা সম্মানী নেই। শুধু বোর্ড সভায় যোগ দেওয়ার জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা থাকে। পরিচালকদের আর্থিক সংগতি বিবেচনা করলে সেটাও অন্তত তাঁদের কাছে খুব বড় কিছু হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বছরে একবার এজিএমে যোগ দিলে কিছু উপঢৌকন পাওয়া যায়। সে বন্দোবস্ত অবশ্য সব কাউন্সিলরের জন্যই থাকে। এতটুকুই যদি প্রাপ্তি হয়, তাহলে কিসের আশায় বোর্ড পরিচালক হতে এমন কপাল ঠুকে মরা?

যাঁরা বিসিবি নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক দিন ধরে কোন্দল-দলাদলি করেছেন, তাঁদেরই যদি প্রশ্নটা করা হয়, উত্তর শুনে আপনার মন আনন্দে ভরে যাবে।

বিসিবি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ আজ ৬ অক্টোবর
বিসিবি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ আজ ৬ অক্টোবর
বিসিবি

সাধারণ ক্রিকেট অনুসারীদের মনের প্রশ্নটা আমি গত কয়েক দিনে কয়েকজন পরিচালক প্রার্থীর কাছে রেখেছি, কিন্তু একটু ঘুরিয়ে। যেমন দু-তিনজনকে জিজ্ঞেস করেছি, আচ্ছা সবাই বিসিবিতে আসতে চাচ্ছে কেন? আগে তো সংগঠক-ক্রিকেটাররা আসতে চাইতেন। এখন দেখি ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন লোকেরাও সেই লাইনে। ঘটনা কী?

শুনে সম্ভাব্য পরিচালকের কণ্ঠেও জেঁকে বসে আমারই প্রশ্ন, ‘আসলেই তো, সবাই কেন ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চায়! আমি বুঝলাম না কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে।’ এরপর যদি জানতে চান, ‘আচ্ছা আপনি কেন আসতে চাচ্ছেন’, তখন দেখবেন সুর পুরোই অন্য রকম, ‘আরে ভাই, ক্রিকেটটাকে তো বাঁচাতে হবে। আমার নিজের কত কাজ আছে, ব্যবসা আছে। তারপরও ক্রিকেটের স্বার্থে মাঠে পড়ে থাকি। জীবনটা তো ক্রিকেটের পেছনেই দিয়ে দিলাম।’

এ রকম কেউ যে একেবারেই নেই, তা নয়। সে দাবি করলে কিছু মানুষকে বরং অসম্মানই করা হবে। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেও কেউ কেউ ক্রিকেট বোর্ডে থাকতে চান, থেকেছেন। তাঁরা কিছু কাজও করেন। নইলে নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো এগোয় কী করে! কিন্তু সে সংখ্যা অতি নগণ্য। তাঁদের বাড়তি প্রাপ্তি সামাজিক মর্যাদা, দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থায় থেকে নামের সঙ্গে ‘বিসিবি পরিচালক’ পরিচয়টা রাখা।

বিসিবি নির্বাচন সামনে রেখে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে
বিসিবি নির্বাচন সামনে রেখে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে
শামসুল হক

তবে ওই ‘আরে ভাই, ক্রিকেটটাকে তো বাঁচাতে হবে...’–জাতীয় কথা শুনলে মনে হতে বাধ্য—এ রকম আরও ১০-১২ জন সংগঠক যদি বাংলাদেশে থাকতেন, দেশের ক্রিকেটের চেহারাই বদলে যেত। মজার ব্যাপার হলো এ রকম কথা বলা সংগঠক দেশের ক্রিকেটে ১০-১২ জন নয়, খুঁজলে আরও অনেকই পাওয়া যাবে। কিন্তু তাঁদের এই নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াতে ক্রিকেটের কতটা উন্নতি হয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো তাঁদের কাছেও নেই।

তারপরও ধরে নিলাম, ক্রিকেটের কাজটা তাঁরা ক্রীড়াসেবামূলক কাজ হিসেবেই করতে চান। এখান থেকে তাঁদের কোনো প্রাপ্তি নেই, খেলাটাকে শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। এবার তাহলে বলুন, মানসিকতার দিক থেকে যাঁরা এ রকম নির্লোভ, যাঁরা শুধু দিতেই জানেন নিতে জানেন না, সেসব মানুষেরা সাধারণত কেমন হন?

সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে এ রকম মানুষ অনেকেই আছেন, যাঁরা নিজের কাজটা নির্বিবাদে করতে চান, কারও সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো তাঁদের স্বভাব নয়। কূটচাল-মারপ্যাঁচ তাঁরা বোঝেন না, রাজনীতি বোঝা তো দূরের কথা। একই ভালো কাজ অন্য কেউ করতে চাইলেও কখনো বাধা দেন না। বরং মিলেমিশে তা করতে প্রস্তুত থাকেন।

কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে আমরা কী দেখি? এমন কিছু লোক ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে চান, ক্রিকেটের মঙ্গল চান, ক্রিকেটের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে চান, যাঁদের মধ্যে কোনো মিলমিশ নেই।

তাঁরা এক ঘাটে জল খেতে চান না। শুধু সংঘাত আর সংঘাত। কেউ কাউকে নিয়ে ভালো কথা বলেন না। একে অন্যকে কী করে বিব্রত করবেন আর বিপদে ফেলবেন, সব সময় সেই ছক কষতে ব্যস্ত। ক্রিকেটের সেবা করার মতো মহৎ এক কাজ করতে নেমে রীতিমতো মারামারি করার অবস্থা। অথচ তাঁদের সবার লক্ষ্যই নাকি এক—ক্রিকেটের পাশে থাকা!

বিসিবি কার্যালয়
বিসিবি কার্যালয়
প্রথম আলো

এটা ঠিক যে বিসিবির পরিচালক পদ মাত্র ২৫টি। কাজেই চাইলেও এর বেশি লোক ক্রিকেট বোর্ডে এসে ক্রিকেটের সেবা করার সুযোগ পাবেন না। এবার তো ২৫টি পদের জন্য শুরুতে প্রায় দ্বিগুণ প্রার্থীই ছিলেন।

কিন্তু তাঁরা কেন ক্রিকেট বোর্ডে এসেই ক্রিকেটের সেবা করতে চাইলেন, সেটা এক বিস্ময়। তাঁদের কারও ক্লাব আছে, কেউ জেলা ক্রীড়া সংস্থা অথবা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে আসছেন, অথবা আসছেন অন্য কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান থেকে। ক্রিকেটের সেবাটা তো সেখানেও করা যেত। কয়জন করেছেন তা?

নিজ নিজ জায়গায় ক্রিকেটের জন্য কিছুই না করে এমন এক জায়গায় এসে তাঁরা সেটা করতে চাচ্ছেন, যেখানে আগে থেকেই অনেকে আছেন। কাজেই সেই জায়গায় ঢুকতে রীতিমতো যুদ্ধই করতে হয়। গালমন্দ শুনতে এবং দিতেও হয়। তারপরও ক্রিকেট বোর্ডে আসতে হবে, ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হতে হবে। ক্রিকেটের ‘সেবা’ করে ক্রিকেটের ‘মধু’ খেতে হবে।

একটা সময় ছিল, যখন বছরের পর বছর ফান্ডিং করে, লিগের সময় দল গড়ার টাকা দিয়ে সংগঠকেরা ক্লাবের সঙ্গে থাকতেন। বিনিময়ে সেই ক্লাবের কাউন্সিলর হতেন। সেটার জন্যও নিজেদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। এখন তা–ও লাগে না।

যে বছর নির্বাচন, সে বছরের জন্য একটা মোটা অঙ্ক দিয়ে দিলেই হলো। ধরুন, তৃতীয় বিভাগের একটা দল চালাতে এক মৌসুমে ১৪-১৫ লাখ টাকা লাগে। বিসিবি থেকে লাখ পাঁচেক টাকা অনুদান আসে। ক্ষমতার জোর থাকলে বাকি ১০ লাখ টাকা দিয়ে আপনি হয়ে গেলেন ওই ক্লাবের কাউন্সিলর।

বেশ কিছু ক্লাবের ক্ষেত্রে এবার এটাই হয়েছে। যেসব ক্লাবের ক্ষমতাশালী অতিথি কাউন্সিলররা স্বার্থের লড়াইয়ে হেরে নির্বাচন থেকে সরে গেলেন, সেসব ক্লাবের প্রকৃত সংগঠকেরা এখন চিন্তায় পড়েছেন। ক্ষমতার জোরে টাকা দিয়ে যে অতিথি কাউন্সিলর এসেছিলেন, ক্রিকেট বোর্ডের মধু খেতে না পেরে বিষ হজম করে চলে গিয়ে তিনি তো আর ক্লাবের দায়িত্ব নেবেন না। এখন ক্লাব চলবে কীভাবে?

ক্রিকেটের মানুষ না হয়েও বিসিবিতে আসতে চাওয়ার একটা বড় কারণ গ্ল্যামার। বিসিবি সভাপতি তো বটেই, অনেক সময় একজন পরিচালকও যে পরিমাণ মিডিয়া কাভারেজ পান, সেটা অনেক মন্ত্রীর কপালেও জোটে না। ‘ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক’ পরিচয়টাই তাঁদের নিজ নিজ পরিমণ্ডলে একটা বাড়তি যোগ্যতা হয়ে যায়।

ধরুন, একজন ব্যবসায়ী ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হলেন। তাঁকে মাঝেমধ্যে টিভিতে দেখায়, তাঁর নাম পত্রিকায় ছাপা হয়। ব্যবসায়ী মহলে সেই পরিচালকের তখন অন্য রকম একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। তাঁর প্রভাব বাড়ে এবং সেটি নিশ্চিতভাবে তাঁর ব্যবসার মুনাফাতেও প্রভাব ফেলে।

বা ধরুন একজন রাজনীতিবিদ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হলেন। তাঁর জন্য নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরার এ বিরাট এক সুযোগ। রাজনৈতিক প্রোফাইলের সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিকেট সংগঠকের নতুন পরিচিতি, যেটি তাঁর নিজ দল এবং ব্যালট বাক্সেও প্রভাব ফেলে। এলাকার মানুষ ভাবে, আরে আমাদের এমপি তো ক্রিকেট বোর্ডেও আছেন! বিরাট ব্যাপার।

আবারও বিসিবি সভাপতি হতে যাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম।
আবারও বিসিবি সভাপতি হতে যাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম।
শামসুল হক

তা এর বাইরে কি বিসিবি পরিচালকের আর কোনো প্রাপ্তি নেই? আছে। নাজমুল হাসানের বিগত বোর্ডে যেমন বিসিবি কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড করে ফেলেছিলেন। দলের সঙ্গে এক-দুজন পরিচালক তো নিয়মিতই যেতেন, সেটা প্রয়োজনও ছিল কখনো কখনো।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালকদের বহর ক্রমেই লম্বা হয়েছে। বাংলাদেশ দলের একই সিরিজ দেখতে দেশ থেকে বিদেশে দু-তিনবার করে আসা-যাওয়ার রেকর্ডও আছে। যেতেন বিজনেস ক্লাসে, থাকতেন পাঁচ তারকা হোটেলে। জীবন যাপনে রাজকীয় স্টাইল। নাজমুল হাসানের শেষের কয়েক বছর তো বিসিবির স্টাফরাও খেলা দেখতে দল বেঁধে বিদেশ যেতে শুরু করেছিলেন।

অনেকে ক্রিকেট বোর্ডে এসে দুর্নীতি করেছেন, টাকার কুমির হয়েছেন—এ রকম অভিযোগ আছে। এবার একটা তদন্তও হচ্ছে এ নিয়ে। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডে কেউ দুর্নীতি করলেও শাস্তি পাবেন; অতীত অভিজ্ঞতার কারণেই সেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

অতীতে দেখা গেছে, একটা পক্ষ ক্রিকেট বোর্ডে আছে, আরেকটা পক্ষ বাইরে থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে। কিন্তু যখন তারা ক্ষমতায় এল, দুর্নীতি নিয়ে আর কথা নেই; কোনো তদন্ত নেই। তখন বাইরে থেকে এত দিন ক্ষমতায় থাকারা দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে থাকেন।

দেখা যাক, এবার সত্যি সত্যি কারও দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে কি না। নাকি দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ গোপন অস্ত্র হয়েই থেকে যায়। দরকারমতো ভয় দেখাতে পকেট থেকে বের হবে, দরকার শেষে আবার তা পকেটে ঢুকে যাবে।

মৌচাকে ঢিল মেরে মৌমাছি উড়িয়ে লাভ কী! তার চেয়ে মৌচাকটা থাকুক। সময়-সুযোগ এলে যার যার মতো করে মধুটা খেয়ে নিলেই তো হলো!

তারেক মাহমুদ Contributor image
ঢাকাক্রীড়া সম্পাদক, প্রথম আলো

কোন মন্তব্য নেই:

In LeBron James' season debut, Lakers storm past Jazz

  November 19 - Luka Doncic scored 37 points with 10 assists and LeBron James added 11 points in 30 minutes of his season debut as the Los A...